Posted by. Disrupt Tech. March 25, 2022
২৩ বছরের পাকিস্তানী শাসনের অবসান একদিনে হয়নি। লক্ষ লক্ষ মানুষের রক্তে রঞ্জিত হয়ে এই বাংলা অর্জন করেছে তাঁর স্বাধীনতা। তাইতো শহীদদের রক্তের দাগ আজও বুকে নিয়ে স্বাধীন এই বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা রঙিন হয়েছে লাল সবুজ রঙে। দীর্ঘ নয় মাসব্যাপী চলা স্বাধীনতা সংগ্রামে গণহত্যার শিকার হয়েছে ৩০ লক্ষ বাঙালী , যার মধ্যে সর্বোচ্চ এক লক্ষ মানুষকে হত্যা করা হয় ২৫শে মার্চ ১৯৭১ রাতের অন্ধকারেই।
এমন ভয়াবহ নৃশংসতা রচনা করার পরও এই ঘটনা সম্পর্কে বিশ্বের মানুষ যথেষ্ট অবহিত নয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ৫১ বছর পরও কেন ২৫শে মার্চ আন্তর্জাতিকভাবে গণহত্যা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি পায়নি চলুন তাঁর বিস্তারিত জেনে নেওয়া যাক এই দিনের ইতিহাস পর্যবেক্ষণ করে।
২৫শে মার্চের রাতের অন্ধকারে কি পরিমাণ নৃশংসতা ও ধবংসযজ্ঞ চালানো হয়েছিলো তার অকাট্য প্রমাণ তুলে ধরে সারি সারি লাশের মিছিল। সেই রাতের গণহত্যায় কত নিরীহ বাঙালী কে প্রাণ দিতে হয়েছিলো তাঁর সঠিক সংখ্যা জানা সম্ভব হয়নি। অস্ট্রেলিয়ার সিডনি মর্নিং হেরাল্ড পত্রিকার ভাষ্যমতে শুধুমাত্র ২৫শে মার্চ রাতেই বাংলাদেশে প্রায় একলাখ মানুষকে নির্বিচারে হত্যা করা হয়।
এছাড়াও তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের প্রকাশিত দলিল থেকেও এই বিষয়ে ধারণা পাওয়া যায়। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন তাঁদের প্রকাশিত শ্বেতপত্রে বলা হয় ১৯৭১ সালের ১লা মার্চ থেকে ২৫শে মার্চ রাত পর্যন্ত এক লাখেরও বেশি মানুষকে হত্যা করা হয়েছিলো।
২৫ মার্চের গণহত্যা শুধু এক রাতের হত্যাকাণ্ডের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না বরং এই রাত ছিলো দীর্ঘ নয়মাসব্যাপী চলা জঘন্যতম গণহত্যার সূচনামাত্র। পরবর্তীতে যুদ্ধ চলাকালীন ৯ মাসে ৩০ লক্ষ নিরাপরাধ নারী-পুরুষ-শিশুকে হত্যার মধ্য দিয়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসররা সৃষ্টি করেছিল বর্বর ইতিহাস, নিষ্ঠুরতা যা সংখ্যার দিক দিয়ে ইহুদি হলোকাস্ট (১৯৩৩-৪৫) বা রুয়ান্ডার গণহত্যা (১৯৪৪) কেও অতিক্রম করে গেছে। ‘গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস’-এ পরবর্তীতে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের এই হত্যাযজ্ঞকে বিংশ শতাব্দীর পাঁচটি ভয়ংকর গণহত্যার মধ্যে একটি বলে উল্লেখ করা হয়।
৫৬ শতাংশ বাংলা ভাষাভাষী জনগণের রাস্ট্রে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে উর্দু চাপিয়ে দেওয়ার মধ্য দিয়ে শুরু হয় ষড়যন্ত্রের। এই ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে গর্জে উঠে বাঙালী প্রথম প্রাণ দেয় ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে। পরবর্তীতে রক্তপাত আর সংঘাত চলমান ছিলো ৫৪’র যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে, ৫৮-তে আইয়ুব খানের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলনে, ৬২-এর শিক্ষা আন্দোলনে কিংবা ৬৪’র নির্বাচনে।
দফায় দফায় এমন মতবিরোধে বেড়েছিলো পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যকার দৈরাত্য। সময়ের সাথে পশ্চিম পাকিস্তানের অত্যাচারের পরিমাণ যেমন বেড়েছিলো তেমনি বেড়েছিলো বাঙালী র প্রতিরোধ। এরই ধারাবাহিকতায় পরবর্তীতে এসেছে ৬৬’র ৬ দফা আন্দোলন। ৬৯’র সামরিক শাসনের পতন ঘটিয়ে ৭০’র নির্বাচন। আন্দোলন আর প্রতিবাদের মধ্য দিয়ে যখন বাঙালী তাঁদের অধিকার আদায় করতে শুরু করে তখনই পাকিস্তান সরকার বাঙালী র এই অদম্য সাহসকে একেবারে শেষ করে দিতে মরিয়া হয়ে উঠে। যার ফলশ্রুতিতে পরিকল্পনা হয় ২৫শে মার্চের গণহত্যার।
১৯৭১ সালের মার্চের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকেই পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পূর্ব পাকিস্তানে সৈন্য আসা শুরু হয়। ২৫শে মার্চের আগে তা চোখে পরার মতন বেড়ে যায়। ১৭ই মার্চ ১৯৭১, হত্যাযজ্ঞ পরিচালনার জন্য পরিকল্পনার দায়িত্ব পায় ১৪ তম ডিভিশনের জিওসি মেজর জেনারেল খাদিম হুসাইন রাজা। পরদিনই মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলি-র সাথে একসাথে তারা অপারেশনের পরিকল্পনা তৈরি করেন।
প্রাথমিক পরিকল্পনা হয় ঢাকাকে কেন্দ্রবিন্দু ধরে সারাদেশে একযোগে অপারেশন পরিচালনার বিশেষত খুলনা, যশোর, রাজশাহী, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, সৈয়দপুর, সিলেট ও রংপুরে। কেড়ে নেওয়া হয় বাঙালী সেনাদের অস্ত্র ও গোলাবারুদ। সিদ্ধান্ত হয় সর্বোচ্চ সংখ্যক সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক সংগঠনের নেতাদের গ্রেফতারের।
এই সবকিছু এতটাই গোপনীয়তা বজায় রেখে করা হয়েছিলো যে গোপনীয়তা রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ পর্যায় থেকে সামরিক বাহিনীর বাঙালী কর্মকর্তাদের বদলি করে সেখানে পশ্চিম পাকিস্তানী সেনা মোতায়ন করা শুরু হয়।
পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ১৯৭১ সালের ১লা মার্চ ইয়াহিয়া খান জাতীয় সংসদের অধিবেশন স্থগিত করে দেন যা ৩রা মার্চ অনুষ্ঠিত হবার কথা ছিলো। এর ফলে বিদ্রোহ আর ক্ষোভে ফেটে পরেছিলো বাঙালী জনতা। পরদিন ২রা মার্চ, প্রতিবাদ হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সমাবেশ থেকে পতাকা উত্তোলন করা হয় যা স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা হিসেবে স্বীকৃতি পায়। ৩রা মার্চ, পল্টন ময়দানে স্বাধীনতার ইস্তেহার ঘোষণা করা হয় এবং জাতীয় সঙ্গীত নির্ধারণ করা হয় “আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি।” উত্তাল মার্চের প্রথম দিন থেকে প্রতিটি দিনই ছিলো ঘটনা বহুল। আর এতে যুক্ত হয় ৭ই মার্চ, রেসকোর্স ময়দানে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণ ‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।”
বঙ্গবন্ধুর এই সংগ্রামী ভাষণের প্রেরণায় শুরু হয় অঘোষিত যুদ্ধের প্রস্তুতি। একদিকে চলতে থাকে অসহযোগ আন্দোলন অন্যদিকে অস্ত্র হাতে প্রশিক্ষণ, ছাত্রদের কুচকাওয়াজ এবং মুক্তিযুদ্ধের আনুষঙ্গিক প্রস্তুতির বিভিন্ন কার্যক্রম।
থমথমে এক আবহের মধ্য দিয়ে শুরু হয়েছিলো ২৫শে মার্চ দিনটি। একদিকে মুজিব-ইয়াহিয়া আলোচনা পন্ড হয়ে যাওয়াতে বাঙালী র মধ্যে দাবানলের মতন ছড়িয়ে পড়েছিলো তীব্র ক্ষোভ, অন্যদিকে আওয়ামীলীগ নেতারা দিনব্যাপী অপেক্ষায় বসে ছিলেন টেলিফোনের। এই দিনে ফোন করে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে প্রেসিডেন্টকে দেওয়া সংবিধানের খসড়ার চূড়ান্ত প্রতিবেদন পেশ করা এবং অনুমোদনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন ইয়াহিয়ার সহযোগী জেনারেল এসজিএমএম পীরজাদা। কিন্ত শেষ পর্যন্ত সেই ফোন আর আসেনি।
২৫শে মার্চ সকালে প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান ও পাকিস্তান পিপলস পার্টির প্রধান জুলফিকার আলী ভুট্টো প্রেসিডেন্ট ভবনে একান্ত বৈঠকে বসেন। বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে ভুট্টো পরিস্থিতি সঙ্কটজনক জানিয়ে চলে যান।
ভুট্টোর সঙ্গে বৈঠকের পর পরই জেনারেল ইয়াহিয়া খান গোপনে বৈঠক করেন পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলের সামরিক প্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল টিক্কা খান, চিফ অব জেনারেল স্টাফ জেনারেল আবদুল হামিদ খান, মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী, মেজর জেনারেল মিঠঠা খানসহ উচ্চপদস্থ সেনা কর্তাদের সাথে।
ইয়াহিয়া খানের সাথে বৈঠক শেষে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মেজর জেনারেল মিঠঠা খান, মেজর জেনারেল জানজুয়া, মেজর জেনারেল ওমর, এবং মেজর জেনারেল নজর হোসেন শাহসহ ঊর্ধ্বতন সেনা কর্মকর্তারা চট্টগ্রাম, রাজশাহী, রংপুর, যশোর, ও কুমিল্লা সেনানিবাস সফর করেন।
এছাড়াও ঐদিন বিকেল থেকেই পাকিস্তানি সেনারা হেলিকপ্টারকে টহল দিতে দেখা যায় এবং সব ধরনের সামরিক সংস্থার সদস্যদের বার্তা দেওয়া হয় অবশ্যম্ভাবী এক সামরিক অপারেশনের জন্য প্রস্তুত থাকতে।
কোন রকম পূর্ব ঘোষণা ছাড়াই গোপণ বৈঠক শেষে প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান ২৫শে মার্চ সন্ধ্যায় প্রেসিডেন্ট ভবন ত্যাগ করে বিমানবন্দরে যান পূর্ব পাকিস্তান ছাড়ার উদ্দেশ্যে। ইয়াহিয়া খান পশ্চিম পাকিস্তানে নিরাপদে পৌছানোর পর তার বাহিনী তৎপর হয়ে ওঠে পূর্ব পাকিস্তানে।
কোন সমাধানে না এসে এভাবে ইয়াহিয়া খানের পূর্ব পাকিস্তান ত্যাগের খবর পৌঁছে যায় বঙ্গবন্ধুর কাছে। তিনি রাতেই দলীয় নেতাকর্মীসহ সকল সাধারণ মানুষকে সতর্ক করে বলেন সর্বোচ্চ ত্যাগের জন্য প্রস্তুত থাকতে। ইয়াহিয়ার হঠাৎ ঢাকা ছেড়ে পলায়ন এবং বঙ্গবন্ধুর সতর্কবার্তায় বাঙালী বুঝতে পারে কিছু একটা ঘটতে চলেছে। তাই রাতেই ছাত্র-জনতা রাস্তায় নেমে গড়ে তুলে অসংখ্য ব্যারিকেড। আর বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা চলে যান আত্মগোপনে।
২৫শে মার্চ রাত ১০টার দিকে ঢাকা সেনানিবাস থেকে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর একটি বড় কনভয় যুদ্ধ সাজে শহরের অভিমুখে রওনা হয়। শহরমুখী এই যাত্রায় সেনাবাহিনীর এই বহর প্রথম প্রতিরোধের সম্মুখীন হয় ফার্মগেইটে।
সেখানে ব্যারিকেড তৈরী করতে বড় বড় গাছের গুঁড়ি, অকেজো স্টিম রোলার এবং ভাঙা গাড়ির স্তূপ জমিয়ে রাখা হয়েছিলো। মুক্তিকামী জনতা ‘জয় বাংলা’ স্লোগানে পথ আগলে দিয়েছিলো পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর যাত্রা। গুলি করে এই প্রতিরোধ ভেঙে এগিয়ে যাওয়ার মধ্য দিয়ে শুরু হয় ২৫শে মার্চ কালরাত্রির অকল্পনীয় হত্যাযজ্ঞ। তাৎক্ষণিক পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর এ আক্রমণের সংবাদ সারাদেশের জেলা ও সাব ডিভিশনে বেতার বার্তার মাধ্যমে জানিয়ে দেওয়া হয়।
রাত ১২টার কিছু আগে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর একটি অংশ রাজারবাগ পুলিশ লাইনসের চারিদিক ঘিরে অবস্থান নিতে শুরু করে। পরবর্তীতে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ৩২ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের অধিনায়ক কর্নেল তাজের নেতৃত্বে পাকিস্তানি সেনাদের কনভয় রাজারবাগ পুলিশ লাইনসে আক্রমণ শুরু করে। পুলিশ লাইনসের ব্যারাকে অবস্থানরত বাঙালি পুলিশ সদস্যরা সেনাবাহিনীকে লক্ষ্য করে পাল্টা গুলি করে। একই সময়ে পরিকল্পনা অনুযায়ী পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ২২তম বালুচ রেজিমেন্টের সেনারা পিলখানায় ইপিআর-এর ওপর হামলা শুরু করে। চরম সীমাবদ্ধতার মধ্যেও ব্যারাকে থাকা বাঙালি সেনারা প্রতিরোধ যুদ্ধ শুরু করেন।
পিলখানা ইপিআর ও রাজারবাগ পুলিশ লাইনস আক্রমণের মধ্য দিয়ে শুরু এই হত্যাযজ্ঞ মুহূর্তেই ছড়িয়ে পরে শাঁখারি বাজারসহ সমগ্র ঢাকাতে। বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে রাতের অন্ধকারে গুলি, বোমা আর ট্যাংকের আক্রমণ চলতে থাকে নিরস্ত্র বাঙালি হত্যা।
আর্চার ব্লাডের “দ্য ক্রুয়েল বার্থ অব বাংলাদেশ” থেকে ২৫শে মার্চ রাতের বেশ কিছু ভয়াবহ চিত্রের তথ্য পাওয়া যায়। সেই রাতে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর অন্যতম নিশানা ছিলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ও শিক্ষকগণ। সেদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোকেয়া হলে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়েছিল এবং ছাত্রীরা যখন আগুন থেকে বাঁচতে হল থেকে দৌড়ে বের হতে শুরু করেন তখন মেশিন গান দিয়ে গুলি করে তাদেরকে হত্যা করা হয়। এছাড়াও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের দিয়ে কবরের গর্ত খুড়িয়ে সেই গর্তে ছাত্রদের লাশ মাটিচাপা দেওয়া হয়েছিলো। একইসাথে সেই সময় সেনাবাহিনী ছাত্রাবাস ও শিক্ষকদের আবাসিক এলাকায় নজিরবিহীন হত্যাযজ্ঞ চালায়।
পাকিস্তানীদের এমন নৃশংসতা আগে থেকেই ধারণা করতে পেরে অনেকেই বঙ্গবন্ধুকে আত্নগোপণে যেতে বললেও শেখ মুজিব তাতে অস্বীকৃতি জানিয়ে শংকা প্রকাশ করে বলেছিলেন, ‘আমাকে না পেলে ওরা ঢাকা জ্বালিয়ে দেবে।’ ২৫শে মার্চ রাত ১টার দিকে কর্নেল জেড এ খানের নেতৃত্বে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর একটা দল ৩২ নম্বর ধানমণ্ডিতে হামলা চালিয়ে শেখ মুজিবর রহমানকে গ্রেফতার করে আদমজী স্কুলে নিয়ে যায়। সারা রাত সেখানে থাকার পর পরদিন বঙ্গবন্ধু সহ তাঁর সাথে গ্রেফতার সকলকে স্টাফ হাউসে নিয়ে যাওয়া হয়। গ্রেফতারের তিনদিন পর বঙ্গবন্ধুকে ঢাকা থেকে করাচি নিয়ে যাওয়া হয়।
পশ্চিম পাকিস্তানের এমন বর্বরোচিত হত্যাকান্ডের বিষয়ে সারা বিশ্ব যেন অনবহিত থাকে তার জন্য বিদেশী সকল সাংবাদিকদেরকে জিম্মি করে রাখা হয়েছিলো। কিন্তু এতেও পাকিস্তান সরকার বিশেষ সুবিধা করতে পারেনি। বিভিন্নভাবে ঘুরে ফিরে সংবাদ পৌছে যাচ্ছিলো আন্তর্জাতিক মহলে। ১৯৭১ সালে আমেরিকার সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডি ভারতের শরণার্থী শিবিরগুলো পরিদর্শন করে পাকিস্তানি সৈন্যদের বিরুদ্ধে সরাসরি গণহত্যা চালাবার অভিযোগ করেন।
পাকিস্তানী জেনারেল রাও ফরমান আলী তার ডায়েরিতে লেখেন, তিনি বাংলার সবুজ মাঠকে রক্তবর্ণ করে দেবেন। ১৩ জুন ১৯৭১-এ সাংবাদিক অ্যান্থনি মাসকারেনহ্যাস তার রিপোর্টে ফরমান আলীর উক্তিটি তুলে ধরে সারা বিশ্বের মানুষের মনোযোগ আকর্ষণ করেছিলেন। ২৫শে মার্চসহ পরবর্তী ৯ মাসের গণহত্যার বিরুদ্ধে দেশে দেশে শুরু হয় পাকিস্তান বিরোধী আন্দোলন। নান আয়োজন আর উদ্যোগের মাধ্যমে বিভিন্ন দেশ তুলে ধরে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে হওয়া এই অন্যায়।
১৯৭১ সালের স্বাধীনতা সংগ্রামের পর ২০১৭ সালে প্রথম বারের মতন পালন করা হয় জাতীয়ভাবে গণহত্যা দিবস। বর্তমানে সরকার চেষ্টা করে যাচ্ছে ২৫শে মার্চকে আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবস হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে। কিন্তু স্বাধীনতার ৫১ বছরেও কেন ২৫শে মার্চ আন্তর্জাতিকভাবে গনহত্যা দিবসের স্বীকৃতি পায়নি সেই সম্পর্কে বলতে গিয়ে ব্রাসেলসে আন্তর্জাতিক আইনে বিশেষজ্ঞ আহমেদ জিয়াউদ্দিন জানান, আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেতে বিশ্বের অন্যান্য দেশকে এই ঘটনাকে ‘গনহত্যা’ দিবস হিসেবে স্বীকার করতে হবে। আর এই বিষয়ে এখন পর্যন্ত কোন দেশে কোন কার্যক্রমই পরিচালনা করা হয়নি।
অর্থাৎ, সরকারের একক প্রচেষ্টায় আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি লাভ সম্ভব নয়। এর জন্য যুক্ত হতে হবে দেশের মানুষ বিশেষত প্রবাসী গোষ্ঠীকে। যদিও বর্তমান সরকারের আন্তরিক প্রচেষ্টায় এই উদ্যোগ অনেকদূর এগিয়েছে। বাংলাদেশের অনেক নাগরিক প্রবাসী হিসেবে বসবাস করছেন বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। আর বাংলাদেশের সঠিক ইতিহাস বিশ্বের কাছে তুলে ধরতে প্রবাসী গোষ্ঠী সমূহের মাঝে এই বিশেষ দিবস উদযাপনের রীতি শুরু করা আবশ্যক। তখনই সরকারীভাবে চালানো প্রচেষ্টা সাফল্যের মুখ দেখতে পারবে বলে আশা করা যায়। ১৯৭১ সালের যে নৃশংসতা বাংলাদেশ প্রত্যক্ষ করেছে সেই ধ্বংসযজ্ঞ থেকে উঠে দাঁড়ানো সহজ ছিলো না। যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ স্বাধীন রাস্ট্র হিসেবে সম্মাান পেলেও চিহ্নিত হয়েছিলো বিশ্বের দ্বিতীয় দরিদ্র দেশ হিসেবে। ৫১ বছরের এই স্বাধীনতার যাত্রায় বাংলাদেশ উঠে এসেছে অন্যতম উন্নয়নশীল দেশের তালিকায়। যে সাহসীকতায় বাংলাদেশ অর্জন করেছে বাংলা ভাষার আন্তর্জাতিক মাতৃভাষার স্বীকৃতি সেই সাহসীকতার মাধ্যমেই শীঘ্রই বাংলাদেশ অর্জন করবে ২৫শে মার্চ কালরাত্রির গণহত্যা দিবস হিসেবে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি। সেই সাথে পুরো বিশ্ব জানবে কতটা ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত ছোট্ট এই ভূখণ্ড।